ঢাকা,শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪

দূর্যোগে সাইক্লোন শেল্টারে তালা, আশ্রয় নিতে পারেনি চকরিয়ার বহু মানুষ

001845asroy-fছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :::

বাড়ির কাছেই বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে।  স্থানীয় মানুষ এ দুর্যোগের সময় ওই সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেনি তালাবদ্ধ থাকায়। সকাল থেকেই এসব শেল্টারের তালা খুলে দেওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও বিদ্যালয়ের শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনই ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় বদরখালী ইউনিয়নে। সরজমিন গিয়ে বিষয়টি সত্যতাও পাওয়া যায়।

জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আঘাত হানতে পারে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এমন তথ্য নিশ্চিত করার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো উপকূলের মানুষগুলোকে শুক্রবার রাত আটটার মধ্যে সাইক্লোন শেল্টারে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক চকরিয়ার উপকূলীয় ৬টি ইউনিয়নের মানুষগুলোকে সাইক্লোন শেল্টার, উঁচু ভবন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে মাইকিং করলেও অনেক মানুষ বসতবাড়ি ও সহায়সম্পদ ফেলে যেতে চাননি। আবার কোথাও সাইক্লোন শেল্টার থাকলেও তা খুলে না দেওয়ায় সেখানে অবস্থান করতে পারেনি মানুষগুলো। গতকাল শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

উপকূলীয় বদরখালী ইউনিয়নের এক নম্বর ব্লকের নিদানতরাণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে দেখা গেছে, এই সাইক্লোন শেল্টারের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। নিচতলায় খোলা জায়গা গবাদী পশু রাখতে পারলেও এই এলাকার মানুষগুলো আশ্রয় নিতে পারেনি সাইক্লোন শেল্টারে। তাদের অনেকেই গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধের ওপর ও পার্শ্ববর্তী নিদানতরাণী জামে মসজিদের দোতলায় অবস্থান নেয়।

এক নম্বর ব্লকের ঢেমুশিয়া পাড়ার বাসিন্দা আবদু ছোবহান, সালাহউদ্দিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে যখন বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যায় তখন আমাদের বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় গবাদী পশু ও পরিবার সদস্যদের নিয়ে নিদানতরাণী সাইক্লোন শেল্টারে যাই আশ্রয় নিতে। কিন্তু গিয়ে দেখি সেখানে তালা ঝুলছে। তাই শেল্টারের নিচে গবাদি পশুগুলো কোনভাবে রেখে পরিবার সদস্যরা মসজিদের দোতলা ভবনে আশ্রয় নিই।

তারা অভিযোগ করেন, সকাল থেকে বিদ্যালয়ের দায়িত্বরত শিক্ষকদের অসংখ্যবার বললেও তারা সাইক্লোন শেল্টারটি খুলে দিতে আসেননি। একই অভিযোগ করেছেন আরো অনেকে।

একই ইউনিয়নের ২ নম্বর ব্লকের কুতুব নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারটিতেও তালা ঝুলতে দেখা গেছে। এ কারণে ওই শেল্টারে কোন মানুষ আশ্রয় নিতে পারেনি। তারা নিজেদেরই বসতবাড়িতে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে কয়েকফুট উচ্চতায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও তীব্র বেগের বাতাসে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। এর পরেও বাড়ির কাছে সাইক্লোন শেল্টার থাকলেও কেন সেখানে যাননি এমন প্রশ্ন করা হলে মগনামা পাড়ার বাসিন্দা ছাবেকুন্নাহার, লায়লা বেগমসহ বেশ কয়েকজন বলেন, ৬ নম্বর সতর্ক সংকেত থাকায় মাত্র দুটি পতাকা উড়েছে। তাই আমরাও এই ঘূর্ণিঝড়কে তেমন গুরুত্ব দিইনি। তাছাড়া জনপ্রতিনিধিরাও আগে থেকে মাইকিংও করেনি এলাকায়। এমনকি ঘূর্ণিঝড় হলে আমরা যে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেব, সেটিও তালাবদ্ধ ছিল। এই অবস্থায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখে কোনমতে সময় পার করেছি।

বদরখালী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) তাজুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বাতাসের তীব্রতার পাশাপাশি ৪৫ ফুট অধিক উচ্চতায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানি বেড়ে যায়। এতে বদরখালী ইউনিয়নের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধগুলো বিলীন হয়ে একাকার হয়ে যায়। এতে আমার চারটি প্রকল্পের ৩২০ একর চিংড়িঘের তলিয়ে গিয়ে ক্ষতি হয় প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার। এছাড়াও মাঠে মজুদ করে রাখা লবণগুলোও পানিতে মিশে যায়। ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে আমার এলাকার অন্তত ৩৫টি বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। একই অবস্থা অন্যান্য এলাকায়ও।

জানতে চাইলে বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. খাইরুল বশর চকরিয়া নিউজকে বলেন, প্রশাসনের নির্দেশনা থাকার পরও কী কারণে সাইক্লোন শেল্টারগুলো বন্ধ রেখেছিল তা কৈফিয়ত চাইব সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এর পরও তাৎক্ষণিক আমি শিক্ষকদের বলেছি, যেসব সাইক্লোন শেল্টারে তালা ঝুলছে তা খুলে দিতে। বিষয়টি ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি।

এ ব্যাপারে জানার জন্য অসংখ্যবার যোগাযোগ করা হয় চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.সাহেদুল ইসলামের কাছে। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, বিগত ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে মহা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন আঘাত হানলে চকরিয়ার উপকূলীয় ইউনিয়ন বদরখালী, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, বিএমচর, চিরিঙ্গা, পশ্চিম বড় ভেওলাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। নিমিষেই বিরানভূমিতে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। সেই দিনের কথা এখনো স্মরণ করে ডুকরে কেঁদে উঠেন উপকূলের মানুষগুলো। পরবর্তীতে উপকূলীয় মানুষগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেশিবিদেশি অর্থায়নে অর্ধ শতাধিক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এবারের ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে সেই সাইক্লোন শেল্টারে উঠতে না পেরে এলাকার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

পাঠকের মতামত: